ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

২১শে ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা রচনাটি সম্পর্কে অনেকেই জানতে চান। তাই আপনাদের সুবিধার্থে রচনাটি বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করছি রচনাটি পড়লে আপনারা ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
আসছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আপনারা চাইলে সেই প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোতে রচনাটি উপস্থাপন করতে পারেন।

পোস্ট সূচিপত্রঃতাই আর দেরি না করে চলুন ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা - ভূমিকা

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম ধাপ ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে অনেক ছাত্র তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে ছিনিয়ে এনেছে এই বাংলা ভাষা। আজ আমরা এই রচনাটির মাধ্যমে জানতে পারবো ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। রচনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।

ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা রচনাটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। কারণ এই রচনার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে এ ধরনের রচনা আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

তাই আপনি যদি কোন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে রচনাটি উপস্থাপন করতে চান তাহলে এই রচনাটি আপনার জন্য হতে পারে একটি আদর্শ রচনা।

ভূমিকা
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম চির স্মরণীয় হয়ে আছে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

সংগ্রাম ও অবদানের নিজ নিজ জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে মানুষদের মধ্যে আছেন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো প্রমুখ নেতা। 
আর আছে বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের বর পুত্র হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছেন। তার জীবনাদর্শে আমরা সংগ্রামী চেতনা ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় পাই।

ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে জমতে থাকে চাপা ক্ষোভ। দুই জাতির শিল্প সংস্কৃতির আলাদা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার চাপিয়ে দিতে থাকে উর্দু ভাষা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। 

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন রাষ্ট্রভাষা উর্দু নীতিকে সমর্থন করলে বাঙালির চাপা ক্ষোভ আন্দোলনে বিস্ফোরিত হয়। অবিলম্বেই সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা অ্যাকশন কমিটি একুশে ফেব্রুয়ারি রাজপথে আন্দোলনের ডাক দেয়। আন্দোলন থামাতে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। 

পুলিশের বাধা অমান্য করে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র, শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ। উত্তাল হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। তারপরও ছাত্র জনতা এগিয়ে যায় অ্যাসেম্বলি হলের দিকে। তাদের থামাতে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। 

ভাষার জন্য প্রাণ দেয় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালির অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠান লড়াই। গড়ে ওঠে ৭১ এর মুক্তি সংগ্রামের ভিত্তি।

বঙ্গবন্ধু
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার খোকা নামে দুরন্ত ছেলেটি হচ্ছে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বিপ্লবী ও দূরদর্শী মনোভাবাপন্ন। অন্যায় অত্যাচার যেখানেই দেখতেন সেখানেই প্রতিবাদ করতেন তিনি। তার এই মহান চারিত্রিক গুণটির জন্যই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। 

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যেমন ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র তেমনি জাতীয় জীবনেও ছিলেন ধুমকেতুর মতো বেগবান। তিনিই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার প্রণীত ছয় দফা বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এ বাঙালি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই পাক শাসকগোষ্ঠীর নানা অত্যাচার ও নির্যাতনে তিনি দমে যাননি। 

বরং সারা জীবন বাঙালির পক্ষে দাবি নিয়ে নিস্বার্থভাবে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সহ সবকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি তার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্তের অগ্নি স্ফুলিঙ্গের উৎসারণ আমরা তার ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা ভাষণে দেখতে পায়। 
যার অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষিত হয়ে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ সাড়া দিয়েছিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তার আহবানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অদ্ভুদয়। 

সর্বোপরি, বাঙালি জাতির অধিকার এবং স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতবার যে কারাবরণ এবং নির্যাতন সাহায্য করেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। আর এজন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই ধারায় প্রবাহমান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস
১৯৪৭ সাল, ব্রিটিশের প্ররোচনায় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় বিভাজনের সীমারেখায় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির নেশার মত্ত। ব্যতিক্রম ছিলেন একজন মানুষ, শেখ মুজিবুর রহমান।

মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রগতিশীল ধারার তরুণ নেতা ২৭ বছর বয়সী শেখ মুজিব দুই বাংলার বাঙ্গালীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করলে গঠন করা হয় বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি। তীব্র জনমতের মুখে বেঙ্গল মুসলিম ওয়ার্কিং কমিটি এক ঐতিহাসিক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। 

তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্থান না পাকিস্তানের যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে? 

১৯৪৭ সালে এই ফর্মুলা নিয়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী ও বাঙালি নেতা শরৎচন্দ্র বসু দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা করতে যান। শরৎচন্দ্র বসু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। 

গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে পাঠিয়ে দেন কংগ্রেস নেতা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর কাছে। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যোগ সাজুশে ১৯৪৭ সালে যুবক শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অপূর্ন থেকে যায়। 

সেই স্বপ্ন মহান পুরুষ মুজিব পূরণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে। মহা সংগ্রামী আর দীর্ঘ ছিল সে পথ চলা। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনে তরুণ বাঙালি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে ১৯৪৮ সালের চৌঠা জানুয়ারি শেখ মুজিব গঠন করলেন ছাত্রলী গ নামের এক অপরাজেয় ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। 

কারাগারে বন্দী ২৯ বছরের সেক্স মুজিবকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর যত সময় গেছে, শেখ মুজিব হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রাণ। ভাষা আন্দোলনের সু কঠিন সময়ে কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবী ছিলেন নেতাকর্মীদের প্রাণপুরুষ। 

১৯৫৩ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামীলিগ মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৫৫ সালে সংগঠন থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। 

১৯৫৬ সালে কোয়ালি সন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইট ডক্টরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করলেও বাঙালি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালে মন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেন শেখ মুজিব। 

ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে শেখ মুজিব উদ্যোগী হয়ে সমমানা ছাত্র নেতাদের নিয়ে গঠন করলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামের গোপন সংগঠন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন। একই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন।

প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এ বছরের পহেলা মার্চ শেখ মুজিবকে আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৬৮ সালের পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। 

সাথে আসামি করা হয় ৩৫ জন সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তাকে। পুরো দেশ জুড়ে তীব্র গণ আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিব সহ সকল আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। 

পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে জয়বাংলা স্লোগানে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।৫ ডিসেম্বর তারিখে আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার আনুষ্ঠানিক নামকরণ করেন বাংলাদেশ। 

১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার আগে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে আওয়ামী লীগ। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে নৌকা প্রতীক পছন্দ করেন। 
সাত ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে দেশরা জানুয়ারি রেসকোর্স জনসভায় বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার মালিক হওয়ার কথা বাংলাদেশের জনগণের। কিন্তু পাকিস্তানের অহংকারী ক্ষমতাসীনদের মাথায় ছিল অন্য চিন্তা। 

পাকিস্তান পিপলস পার্কিন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নাম করে ঢাকায় আসেন। তিনদিন বৈঠক চলার পর আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ভুট্টোর দাবিত তীব্র সমালোচনা করে বলেন, বুদ্ধ সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ। 

পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদে বৈঠক স্থগিতার ঘোষণা দিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধু সভাপতি তে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরী বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়। 

সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ মুজিব ৩ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ৭ তারিখের মধ্যে সরকারি মনোভাব পরিবর্তন না হইলে রেসকোর্সে আমি আমার ভাষণ দিয়ে দিব। সাত মার্চের আগেও নানা ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য আলাদা রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলেছেন। ৭ মার্চ সারাদেশে টানটান উত্তেজনা। 

দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে কখন তাদের নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করলেও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন। 

১৯৭৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে সাত মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিস্কার বলা হয়েছিল এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। 

৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক কৌশলে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই মূলত পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। সাত মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা মূলত স্বাধীনতার এক দফায় রূপান্তরিত হয়। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, টেলিভিশন, বেতার সহ সমস্ত দপ্তর বঙ্গবন্ধু নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। 

পাকিস্তানীরা বুঝে যায়, পূর্ব পাকিস্তান তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বাঙালির নাম ও নিশানা মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করে ইয়াহিয়া সরকার। বাঙালি অফিসারদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ে এসে পাকিস্তানি অফিসারদেরকে গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে থাকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈন্য। 

ততদিনে ইতিহাসের বৃহত্তম আত্মত্যাগ করার জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করে ফেলেছে বঙ্গবন্ধু। ২৩ মার্চ ভরে পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেন। এটা ছিল সেই পতাকা যা বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের জুন মাসে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে জয় বাংলা বাহিনীর হাতে গচ্ছিত রেখেছিলেন। 

২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ।কুচকাওয়াজ শেষে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে গার্ড অফ অনার প্রদানকারী দলের সালাম গ্রহণ করেন। এদিকে ইয়াহিয়া খান আর বঙ্গবন্ধুর মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু নিজে থেকে আলোচনা ভেঙে দেননি। কারণ, তিনি বল ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের কোর্টে। 

২৫ মার্চ রাত ৮ টায় ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে নির্দেশ দিয়ে যান গণহত্যা শুরু করার। রাত সাড়ে এগারোটায় পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বাসির উপর বর্বর হামলা শুরু করেন। ওদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা হামলা শুরুর প্রায় সাথে সাথেই স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন। 

ইংরেজিতে লেখা এ ঘোষণাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিল পত্র তৃতীয় খন্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা আছে। ওয়ারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রাম দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আরেকটি বার্তা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে বিশেষ ব্যবস্থায় পাঠানো হয়। 

সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সৈন্য ও অফিসাররা প্রতিরোধ করে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিনদিন পর তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। 

বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে বন্ধন নগরী চট্টগ্রাম থেকে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছায় রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে। ঢাকার মগবাজার ভিএইচএফ স্টেশন থেকে প্রেরিত বার্তাটি চট্টগ্রামের সলিমপুর ভি এইচ এফ স্টেশনে রিসিভ করেন টেকনিশিয়ান আব্দুল হাকিম। 

আব্দুল হাকিম স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা রিসিভ করে টেলিফোনে সহকারী প্রকৌশলী গোলাম রাব্বানী কে জানান। গোলাম রাব্বানী সে বার্তা লিখে নিয়ে সাবেক মন্ত্রী একে খান সাহেবের বাসায় টেলিফোন করলে তার মেয়ে, আওয়ামী লীগ নেতা এমআর সিদ্দিকীর স্ত্রী ফোনটি রিসিভ করে বার্তাটি লিখে নেন। 

দুপুরে ঘোষণাপত্র টি চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কন্ঠে প্রচারিত হয়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে এম এ হান্নানের কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পত্রটি আবারও প্রচার করা হয়। মেজর জিয়াউর রহমান দৃশ্যপটে আসার সুযোগ পান ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়। অন্য যে কোন সামরিক কর্মকর্তা এই বিরল সুযোগ পেতে পারতেন। 

মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররাও অংশ নিয়েছে। এটা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন অনুভব করায় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ভারের কাছে অবস্থানকারী কোন বাঙালি অফিসার কে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। 

তারা প্রথম যোগাযোগ করেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল এ অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকার রফিকুল ইসলামের সাথে। ক্যাপ্টেন রফিক চব্বিশ মার্চ রাতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। যুদ্ধরত ছিলেন বলে ক্যাপ্টেন রফিক চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে আসতে পারেননি। 

তারই পরামর্শে পটিয়া এলাকায় নিরাপদে অবস্থানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হয়। চট্টগ্রাম বেতারের নিজস্ব শিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মাদ সাবাস মাঘ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান কে নিয়ে আসেন। বেলাল মুহাম্মদ এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৈরি করা বিবৃতি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার ঘোষণার রেফারেন্স সহ পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। 

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। এই মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সব সাহস আর ত্যাগের উৎস কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ তাই সমার্থক।

উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অনন্য নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক। তার দূরদর্শী, বিচক্ষণ এবং সঠিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তিনি সবসময় জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছেন। 

সমস্ত জাতিকে তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনা ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তার আত্মত্যাগ জাতিকে মহান মর্যাদায় অধিষ্ট করেছে। তাই আজও তিনি দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ের চির অম্লান হয়ে রয়েছে।

লেখকের মন্তব্য - ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

প্রিয় পাঠক আশা করছি আপনারা ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা রচনাটি সম্পর্কে জানতে পেরে উপকৃত হয়েছেন। চেষ্টা করব আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আরো নতুন নতুন আর্টিকেল আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা। 

প্রতিদিন নিত্য নতুন ও তথ্যসমৃদ্ধ আর্টিকেল পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ফলো দিয়ে রাখুন। আপনার কোন পরামর্শ বা মতামত থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। এতক্ষণ ধৈর্য সহকারে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আয়াত ওয়ার্ল্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url